কৃষকের বঞ্চনার দায় কে নেবে

কর্তৃক farukgangni
আমনের পর বোরো ধানেও মার খেয়ে হতাশাগ্রস্ত দেশের কৃষককুল। ঈদ আসন্ন। সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের প্রাক্কালে এ ক্ষতি তাদের হৃদয়ের ক্ষতকে আরও রক্তাক্ত করেছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমিতে ধান চাষ করার পর এমন একটা সময়ে এসে সেই শ্রমের মূল্যটুকুও পাচ্ছেন না তারা। টাঙ্গাইলে দুঃখে ক্ষোভে নিজ হাতে ফলানো পাকা ধানের সোনালি ক্ষেতে নিজেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন কৃষক; রংপুরে রাস্তায় ধান ঢেলে দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন চাষিরা; এ পেশা ছেড়ে দেবেন বলে আক্ষেপের সঙ্গে জানিয়েছেন। এবার বোরো মৌসুমে এমন সব উদ্বেগজনক কা- ঘটেছে। অথচ কৃষক বাঁচানোর কথা বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় এবার বোরো সংগ্রহ অভিযানের তারিখ এগিয়ে এনেছিল। কিন্তু বাস্তবে এর ন্যূনতম সুফলও পাননি কৃষক।

কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষকের ভাগ্য নিয়ে কেন এই প্রহসন? কৃষিবান্ধব সরকারের সময়েও
কেন কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন কৃষক? রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীতে কেঁপে দেশের মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেন যারা, তাদের রক্ষার দায় কে নেবেÑ এমন প্রশ্নের উত্তর নেই; বরং দায় এড়াতে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় একে অন্যকে দুষছে। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক গণমাধ্যমকে বলেছেন, সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে প্রতিবছর যে ধান-চাল সংগ্রহ করে, তাতে কিছু রাজনৈতিক কর্মী, চালকল মালিক (মিলার) ও ব্যবসায়ী লাভবান হচ্ছে; কৃষকের কোনো লাভ নেই। এবার বোরো মৌসুমে ধানের বাজারমূল্য অপ্রত্যাশিতভাবে কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিগগির কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্যÑ এই তিন মন্ত্রণালয় বসে করণীয় ঠিক করব।

কৃষক তালিকা নিয়ে ধূম্রজাল
এবার ক্ষেত থেকে বোরো ধান ওঠার পর পরই ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে বলে সরকারের তরফে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু আদতে তা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, কৃষকের তালিকা নিয়েই দুই মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রকৃত কৃষকের তালিকা দিতে গড়িমসি করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। আর কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ইতোমধ্যে কৃষকের হালনাগাদ তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে।
এদিকে মাঠপর্যায়ের চিত্র বলছে, নির্ধারিত সময় অনেক আগে শুরু হলেও বগুড়ায় এখনো শুরু হয়নি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। বোরো চাষিদের হালনাগাদ কোনো তালিকা নেই খাদ্য বিভাগের কাছে। জেলার ১২ উপজেলায় একই চিত্র দেখা গেছে। সরকার নির্ধারিত ধানের দরে খুশি হলেও বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার কৃষকরা বলছেন, এখনো কৃষি বিভাগ কৃষকদের তালিকা তৈরি করেনি। অনেকের কৃষক কার্ড এরই মধ্যে কব্জা করেছেন কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা আর ফড়িয়ারা। অভিযোগ রয়েছে, অনেক প্রান্তিক কৃষক তার নাম তালিকায় আছে শুনলেও কার্ড চোখে দেখেননি। ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্ত অঞ্চল বগুড়ার শেরপুর, ধুনট ও নন্দীগ্রাম উপজেলা। একই অবস্থা এসব জায়গায়ও।
খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার আমাদের সময়কে বলেছেন, সরকারিভাবে শস্য সংগ্রহে কোনোভাবেই অনিয়ম হতে দেওয়া হবে না। প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকেই ধান কিনবে সরকার। এ জন্য ক্রয় কমিটিতে যুক্ত স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তদারকি জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, কৃষি বিভাগকে একাধিকবার তাগাদা দিয়েও কৃষকের হালনাগাদ তালিকা পাওয়া যায়নি। আর এ তালিকা না পাওয়ার কারণেও কৃষকের ভোগান্তি হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। মন্ত্রী বলেন, দেশে কী পরিমাণ জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে, কতজন কৃষক চাষ করেছেনÑ এমন সব তথ্য সংগ্রহের দায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) অধীন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের।
কিন্তু ডিএই মহাপরিচালক মীর মো. নুরুল ইসলাম বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে কৃষক-তালিকা চেয়েছে বলে কোনো তথ্য আমার জানা নেই। মাঠপর্যায় থেকে কৃষকের তথ্য সরাসরি আমাদের কাছে আসে না। উপজেলা পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা অনেক আগেই তথ্য তুলে দিয়েছেন থানা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের হাতে। এখন তারা কোনো কারণে যদি তালিকা প্রেরণে গড়িমসি করেন, সে দায় তো তাদেরই নিতে হবে।

অনেক কৃষকের কার্ড বেহাত
বিদ্যমান বাস্তবতা বলছে, সামান্য অর্থ বা ভাঁওতা দিয়ে অনেক কৃষকের ‘কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড’ হাতিয়ে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দল ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের একশ্রেণির অসাধু কর্মচারীরও যোগ রয়েছে তাদের সঙ্গে। ওইসব নেতাকর্মী ও অসাধু কর্মচারী কার্ডের মাধ্যমে লুটে নিতে চাইছে কৃষকের মুনাফা। জানা গেছে, সরকারি কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডধারী কৃষকই সরকারি গুদামে নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান বিক্রি করতে পারবেন। নির্বিঘেœ কাজটি করতে পারলে একজন কৃষকের টনপ্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ হওয়ার কথা। অভিযোগ রয়েছে, কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের একশ্রেণির অসাধু কর্মচারী ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা সরকারি ঘোষণার পর পরই কৃষকের কাছ থেকে ওই কার্ড হাতিয়ে নিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক কৃষকের কার্ড এক-দুই দিনের মধ্যেই বেহাত হয়ে গেছে।

উঠছে না ধানের উৎপাদন খরচ
সরকারি হিসাব বলছে, চলতি বছর প্রতিকেজি বোরো ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে সাড়ে ২৪ টাকা। আর প্রতিকেজি চালের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৩৬ টাকা। এ হিসাবে প্রতিমণ (কেজির হিসেবে) ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ৯০৬ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ বর্তমানে দেশের হাট-বাজারগুলোয় প্রতিমণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতিমণ ধানে কৃষকের লোকসান দাঁড়াচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। বর্তমান দরে কৃষক তার কষ্টার্জিত ফসল বিক্রি করে সচ্ছলতার মুখ দেখা তো দূরের কথা, জীবিকা চালানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অথচ গত এক দশক ধরেই ধানের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন কৃষক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ধান উৎপাদন বৃদ্ধির হারে শীর্ষে বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে আউশ, আমন ও বোরো মিলে মোট ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে আউশ মৌসুমে ২৯ লাখ ২০ হাজার টন ও আমনে ১ কোটি ৪৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, পর পর কয়েক বছর ধানের বাম্পার ফলনের ফলে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু কৃষকের ভাগ্য বদলাচ্ছে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গতকাল জানায়, দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ৪৩ লাখ৬৪ হাজার ৫২৩। প্রান্তিক কৃষক ৭৯ লাখ ৮০ হাজার ৬৪০, ক্ষুদ্র কৃষক ৬১ লাখ ৪৯ হাজার ৩৯৪ ও মাঝারি কৃষকের সংখ্যা ২৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫৬। আর এ বছর বোরো চাষ করেছেন ৪ লাখ ২৫ হাজার ৬২৮ জন। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ করে ফসল ফলিয়ে ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রি করে দেন। এ সময় যদি ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়া যায়, তা হলে এই দুই শ্রেণির কৃষক পথে বসে যান।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন

shares
error: Content is protected !!